টেকনাফের আধুনিক মানের মেরিন সিটি হাসপাতালের প্রায় ৫ কোটি টাকা মেরে দিয়ে লাপাত্তা হওয়ার কয়েক বছর পর সংবাদ সম্মেলন করেছে ক্ষতিগ্রস্ত শেয়ার হোল্ডাররা। ২৭ জানুয়ারী (সোমবার) বিকাল ৪ টায় মেরিন সিটি হসপিটালে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন ভুক্তভোগিরা। তারা অভিযোগ করেন-দীর্ঘদিন ধরে লাপাত্তা এমডি উখিয়ার নুরুজ্জামান প্রকাশ ভাক্কাইয়া ও চেয়ারম্যান সাবেক কাউন্সিলর কোহিনুর আক্তারের বিরুদ্ধে। তাদের কারনে আধুনিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছে টেকনাফবাসী। এখন টেকনাফের সমস্ত মানুষকে চিকিৎসা সেবা নিতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় যেতে হচ্ছে। ২০০ শেয়ারহোল্ডারের ৫ কোটি টাকা সংগ্রহ নিজেদের নামে করে ও কোন ব্যাংক একাউন্ট না করে লুটপাট করে খেয়ে ফেলছে তারা।
এছাড়াও চিকিৎসকদের বেতন ও যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ ভূয়া চেক প্রদানের কারনে বেশ ক’টি প্রতারনা মামলাও চলমান রয়েছে। এর আগেও নুরুজ্জামান একইভাবে চেক প্রতারণা মামলায় হাজত বাস করেছে। জানা গেছে, টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে অবস্থিত মেরিন সিটি হাসপাতালটি ৬৫ জন শেয়ার হোল্ডার নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালে। প্রতিষ্টানটিতে শুরু থেকেই স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলর কোহিনুর আক্তার পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলার কাজিপাড়ার মাষ্টার বাড়ির মৃত তাহের মিয়ার ছেলে নুরুজ্জামান এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এই হাসপাতালের শেয়ার হোল্ডার ৬৫ জন হলেও মোট শেয়ারের পরিমান ২০১টি। প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয়েছে আড়াই লাখ টাকায়। সেই হিসেবে বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। শুরু থেকে প্রতিষ্টানটির কোন অনুমোদন নেই এবং পুরণ করতে পারেনি অনুমোদনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্তও তারা। সেই কারনে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে একাধিকবার চিঠি ও হসপিটাল বন্ধের নোটিশ আসে।
প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার অধ্যাপক আবু তাহের, মুহাম্মদ শাহজাহান ও শাহ আলম বিপ্লব সংবাদ সম্মেলনে জানান, আমাদের ঘামের টাকা নিয়ে হসপিটালটির প্রতিষ্টা লগ্ন থেকে প্রতারণার আশ্রয় নেয় নুরুজ্জামান। যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্টানের নিয়ম ভঙ্গ করে একক মালিকানা দেখিয়ে নিজের নামে অনুমোদনের আবেদন করেন তিনি। পরে অনুমোদনের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরীক্ষক দল পরিদর্শনে এলে বিষয়টি জানাজানি হয় এবং শেয়ার হোল্ডারদের আবেদনের প্রেক্ষিতে অনুমোদন আটকে যায়। এছাড়াও প্রতিষ্টানের নামে আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যাংক হিসাব খোলার নিয়ম থাকলেও নুরুজ্জামান ও কোহিনুর মিলে কোন ব্যাংক হিসাব ছাড়াই আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলো। প্রতি মাসে নির্বাহী কমিটিকে আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রদানের কথা থাকলেও এসব নিয়মের কোন তোয়াক্কা করেনি। বিগত সময়ে মনগড়া একটি হিসাব উপস্থাপন করে তাদের পছন্দের কয়েকজন শেয়ারহোল্ডারদের ৫/১০ হাজার টাকা লভ্যাংশ প্রদান করে। তখনই এসব কর্মকান্ডে বিব্রত হয়ে নির্বাহী কমিটির সভায় নুরুজ্জামানকে যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসার নিয়ম মেনে বারবার প্রাতিষ্টানিক স্বচ্ছতা বজায় রাখার চাপ প্রয়োগ করলে কোহিনুরের প্রত্যক্ষ আশকারায় সে এসব কথার পাত্তা দেইনি। উল্টো এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নুরুজ্জামান-কোহিনুরের হাতে হেনস্থার শিকার হয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। এমনকি মামলার আসামীও হতে হয়েছে।
সর্বশেষ হাসপাতালের নামে যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন মালামাল ক্রয় বাবদ একের পর এক মোটা অংকের পাওনাদার এসে ভিড় করতে থাকে। অথচ শুরুতে হাসপাতালের সমস্ত মালামাল ক্রয় বাবদ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বলে প্রায় কোটি টাকার বেশী আত্মসাৎ করে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য বিগত সময়ে বারবার উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে নির্বাহী কমিটির বৈঠকের সময় নির্ধারন করা হয় এবং ওই বৈঠকে চাপের মুখে পুনরায় বিগত সময়ের মোট আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রদানের সিদ্ধান্তে রাজি হয় নুরুজ্জামান। সেই থেকে তিনি প্রতিষ্টানের সাথে কোন যোগাযোগ না রেখে লাপাত্তা হয়ে যায়। এরপর ৫ আগষ্ট পরবর্তি সরকার পরিবর্তনে সেই নুরুজ্জামান টেকনাফের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে হসপিটাল ভাড়া দেওয়ার চুক্তির জন্য দৌড়ঝাপ শুরু করে। তখন প্রায় শেয়ারহোল্ডাররা খবর পেয়ে তাকে খুঁজতে থাকেন কিন্তু তিনি কারো সাথে দেখা করেন না।
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানান, ৬৫ জন শেয়ারহোল্ডারের রক্ত থাকতে নুরুজ্জামান কোনদিন আর আসতে পারবেনা এই প্রতিষ্ঠানে। আসলেও তাকে পুর্বের সমস্ত হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দিতে হবে এবং সমস্ত টাকা বুঝিয়ে দিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। এখন টেকনাফের চিকিৎসা সেবার স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে হাসপাতাল চালু করার।
জানা গেছে, হসপিটালের সাবেক মেডিকেল অফিসার ডা: নুসরাত তৎকালিন চাকুরী ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার সময় নুরুজ্জামান স্বাক্ষরিত বকেয়া বেতন বাবদ সাড়ে চার লাখ টাকার একটি চেক প্রদান করেন। কিন্তু চেকটি ব্যাংকে ডিজঅনার হয়। এই বিষয়ে তার বিরুদ্ধে বরিশাল আদালতে একটি চেক প্রতারনা মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় আদালত তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এর আগে উখিয়ার এক ব্যক্তির করা চেকের মামলায় তাকে এক বছরের সাজা ও ১৫ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন কক্সবাজারের একটি আদালত।
হাসপাতালের শেয়ারহোল্ডাররা জানান, হসপিটাল প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে আমাদের সাথে প্রতারণা করে আসছে নুরুজ্জামান। বারবার এসব বিষয়ে বললে তৎকালিন এমপির প্রভাব, মহিলা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর হিসেবে কোন শেয়ারহোল্ডারকে টাকা তো দুরের কথা হিসাব পর্যন্ত দেয়নি। এভাবে শেয়ারহোল্ডারের টাকা মেরে ওরা রাজার হালতে বসবাস করেন। এখন আমাদের আর কোন উপায় নেই পথে বসা ছাড়া। এখন হাসপাতাল চালু করতে হলে ৫০ লাখ টাকা দরকার হবে। প্রায় জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত শেয়ারহোল্ডাররা সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে হসপিটালটি চালু করণে রাজনীতিবিদ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী এবং প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রায় শেয়ারহোল্ডাররা উপস্থিত ছিলেন।